মুগ্ধতায় পিঁপড়াবিদ্যায় !!!
একটা ভিডিও ক্লিপ কে কেন্দ্র করে পিঁপড়াবিদ্যার কাহিনী গড়ে উঠেছে। বেকার মিঠু একটা MLM কোম্পানিতে জয়েন করার পর অল্প কিছু টাকা পেয়ে একটা ফোন কিনতে যায়। চুরি হয়ে যাওয়া একটা ফোন চোরের কাছ থেকে কম দামে কিনে নেয়। ভিডিও ক্লিপটা এই ফোনেই ছিল। জনপ্রিয় অভিনেত্রী রীমা আর তার বয়ফ্রেন্ড অয়নের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের একটা ভিডিও। এই ভিডিও টা নিয়েই চলতে থাকে নানা রকম ব্ল্যাকমেইল। সুযোগ পেয়ে কথা কম বলা চুপ থাকা ছেলেটাও অন্যের জন্য তৈরী করে ফাঁদ। পাল্টা ফাঁদে বদলে যায় অনেক কিছু। কাহিনী মোড় নেয় অন্য দিকে।
মুভির শুরুটা অনেক বেশি চমকপ্রদ। বেকার মিঠু যখন চাকরী না পেয়ে “লাকি সেভেন” নামে একটা MLM কোম্পানিতে ঢুকে তখন দর্শক স্বভাবতই ডেসটিনি ডেসটিনি বলে চিৎকার শুরু করে। রাইট হ্যান্ড আর লেফট হ্যান্ডের ব্যাপারগুলো যখন বুঝাচ্ছিল তখন দর্শকের চিৎকার এতই বেড়ে যায় যে ডায়ালোগ ঠিক বুঝাই যাচ্ছিল না। শুরু থেকেই মুভির পাঞ্চ লাইনগুলো এতই দূর্দান্ত ছিল যে হাসি চেপে রাখা কষ্টকর। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী চমৎকারভাবে এটার চিত্রনাট্য লিখেছেন। বিভিন্ন পরিস্থিতে ডায়ালোগ আর সেটা ডেলিভারির টাইমিং দেখে মুগ্ধ হয়েছি। যতটা আশা করছিলাম মুভির প্রথমার্ধ তার চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ করেছি। কখনো হাসতে হাসতে খিল ধরে যাওয়া, কখনো ভাবনায় পড়ে যাওয়া। গোলাম মাওলা নবীরের সিনেমাটোগ্রাফী এই মুভির অন্যতম আকর্ষনীয় দিক।
মুভিতে রীমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন শীনা চৌহান। বিপিএল’র সময় উনার উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। উনি যে এত ভাল অভিনয়ও জানেন সেটা জানা ছিল না। রীমা চরিত্রে নিজেকে সুঅভিনেত্রী হিসেবে প্রমান করলেন। ছবিতে কিছু অন্তরঙ্গ দৃশ্য-ডায়ালোগ ছিল, সেগুলোতে তিনি ছিলেন পারফেক্ট। আবার যখন নিজের রাগ প্রকাশ করতেন তখন যেন সব কিছু ছাড়িয়ে যেতেন। পুরো সিনেমায় তার অভিনয়ের পরিমিতিবোধের প্রশংসা করতে হয়। তাছাড়া রীমা ক্যারেক্টার টা যে রকম, সে রকম ক্যারেক্টারে তাকে ছাড়া যেন ভাবাই যায় না। আমাদের দেশের কোন অভিনেত্রী এই চরিত্রটাকে এভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। রীমা চরিত্রের জন্য শীনা চৌহান ছিল পারফেক্ট চয়েস। তবে পশ্চিমবঙ্গের একজন অভিনেত্রীর এত চমৎকারভাবে বাংলাদেশীয় উচ্চারনে কথা বলাতে মুগ্ধ হয়েছি। ভেরী ওয়েল ডান…
গল্পটা যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সে হচ্ছে মিঠু। মিঠু চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন নতুন অভিনেতা মিঠু। মিঠুর মধ্যে মোশারফ করিমের একটু ছাপ আছে, কথা বলার ধরন অনেকটাই উনার মত। কিন্তু মিঠু একটু বেশিই সাবলীল। পুরো ছবিতে হাস্যরসের নামে একবারও তাকে ভাঁড়ামি করতে দেখা যায়নি। মিঠুর চেহারায় একটা গোবেচারা ভাব আছে যেটা এই ক্যারেক্টারের জন্য পারফেক্ট। দেখলে মনে হয় কিছুই বুঝে না, অথচ মুভির এন্টারটেনমেন্টের অধিকাংশই এসেছে মিঠুর পারফরমেন্স থেকে। তার ডায়ালোগ, এক্সপ্রেশন, হিউমার, টাইমিং সব কিছু মাতিয়ে রেখেছে পুরোটা সময়। ভিডিও এর বিনিময়ে সে যখন রীমার কাছে এক ঘন্টা সময় চায়, তার চাওয়ায় ধরন দেখে স্পীচলেস হয়ে যাওয়াটা যেন বাধ্যতামূলক। আবার পূর্ব প্রেমিকা সাথীর স্বামী রিদওয়ানের সাথে মিঠুর কথোপকথনের অংশগুলোও অনেক উপভোগ্য। সুযোগ পেয়ে একজন সহজ সরল মানুষও কিভাবে লোভ আর খারাপের দিকে লিপ্ত হতে পারে তা মিঠু ক্যারেক্টার টা দিয়ে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে মুভিতে।
পিঁপড়াবিদ্যায় বেশ কিছু পার্শ্ব চরিত্র ছিল। রীমার বয়ফ্রেন্ড অয়ন চরিত্রে ছিলেন সাব্বির হাসান লিখন। সাব্বিরকে অনেক গুছিয়ে কথা বলার জন্য আমার অনেক আগে থেকেই বেশ পছন্দ। সাব্বির একাধারে রেডিও আরজে, কন্ঠশিল্পী, ডেন্টিস্ট আর অভিনেতা। অভিনয় তেমন করেন না। প্রথম দেখেছিলাম শিহাব শাহীনের “মনসুবা জংশন” টেলিফিল্মে তাহসানের বন্ধুর চরিত্রে। তখনি মনে হয়েছে এই ছেলে ভবিষ্যতে অভিনয় করলে ভাল করবে। হয়েছেও তাই। পিঁপড়াবিদ্যায় অয়ন ক্যারেক্টারটা বেশ স্মার্টলি প্রেজেন্ট করেছেন। মুভিতে শীনা চৌহানের হিরো সাব্বির হলেও পিঁপড়াবিদ্যার হিরো সাব্বির না। সামনে তাকে প্রধান চরিত্রে দেখলে ভাল লাগবে। সাব্বিরের মত স্মার্ট আর গুড লুকিং অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে অনেক প্রয়োজন। সাব্বির ছাড়াও সাথী আর রিদওয়ান চরিত্রে মৌ আর ডনও অনেক ভাল করেছে, স্পেশালি গোলাম সামদানী ডন। স্বল্প পরিসরে মুকিত জাকারিয়াও মাতিয়ে গেছেন। সিনেমায় মিঠুর মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা মহিলা অনেক ওভার অ্যাক্টিং করেছেন, আসলে ওনার ওভার অ্যাক্টিংটাই ছিল প্রপার অ্যাক্টিং। আমাদের সমাজে টিপিক্যাল মায়েরা কেমন হয় সেটা তিনি সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন।
মুভিটা দেখার সময় ছোটখাট কিছু ব্যাপার ছাড়া কোন নেগেটিভ দিকই চোখে পড়ে নাই। হয়তো শুরু থেকে দারুন উপভোগ করছিলাম বলেই নেগেটিভ কিছু চোখ এড়িয়ে গেছে। পিঁপড়াবিদ্যার প্রথমার্ধ অনেক উপভোগ্য হলেও শেষার্ধে সেটা ঠিক ধরে রাখতে পারেনি, একটু ঝুলে গেছে। বিরতির মাঝখানে মিঠু-রীমার অন্তরঙ্গ অংশটুকু কেটে দেয়া হয়েছে কিনা বুঝা যাচ্ছিল না। সিনেমার শুরুতে মিঠু চোরাই ফোনটা কিনে চোরকে সিমটা দিয়ে দেয়, তারপরও মোবাইল ট্র্যাকিং করে রীমা মিঠুর নাম্বারটা জেনে যায়। এখানে অনেক দর্শকই ভাবতে পারে পুরান সিম টা ব্যবহার না করার পরও রীমা কিভাবে মিঠুর নতুন নাম্বারটা পেল। মুভিতে মোবাইল ট্র্যাকিং এর ব্যাপারটা একটু ডিটেইলি উপস্থাপন করলে সাধারন দর্শকের জন্য আরেকটু ভাল হত। সিনেমার প্রথমার্ধের পর মিঠু একটা কাপড়ের দোকানে রাতে থাকতো, দোকানের মালিক গালাগালি করে তাকে রাতে থাকতে দিল। কিন্তু দোকানের মালিক কে, মিঠুর সাথে তার কি সম্পর্ক, কতদিনের জন্যেইবা থাকতে দিল বা কেন দিল এই ব্যাপারগুলো পরিস্কার ছিল না। কিছু কিছু জায়গায় সিনেমার কালার গ্রেডিং ছিল বেশ খারাপ, ব্যাপারটা বেশ দৃষ্টিকটু। আর সিনেমার শেষ দিকে তাড়াহুড়ার ব্যাপারটা অনেক চোখে লাগছিল। হুট করেই যেন শেষ হয়ে যাওয়া…
সিনেমার প্রথমার্ধের মেকিং একদম নিখুঁত মনে হয়েছে আমার কাছে। পিঁপড়াবিদ্যার স্ক্রীনপ্লে আর সিনেমাটোগ্রাফি ছিল অসাধারন। চিরকুটের গাওয়া “লেজে রাখা পা” গানটা মনোমুগ্ধকর, লিরিক মিউজিক সবই দূর্দান্ত, চিরকুট আবারো ফাটিয়ে দিয়েছে। ছবিটার শেষে যখন দেখলাম ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে টকিং টমের আরমান উল হক আর হৃদয় খানও ছিল তখন বেশ অবাক হয়েছি। হৃদয় খান, আরমান হক আর চিরকুট মিলে চমৎকার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর উপহার দিয়েছে। মুভির লোকেশন আর সেটার পরিমিত ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মত। পিঁপড়াবিদ্যা অনেক উপভোগ্য একটা সিনেমা; যেটা দর্শককে স্তরে স্তরে আনন্দ দেয়, ভাবতে শেখায়, হয়তো কখনো কষ্টও দেয়। কিছুদিন আগে মুরাদ পারভেজের অনেক প্রশংসিত “বৃহন্নলা” সিনেমাটা সময়ের অভাবে দেখা হয় নাই, এটা ছাড়া যদি সব কিছুর পর এক কথায় যদি পিঁপড়াবিদ্যা সম্পর্কে বলতে হয় তাহলে বলবো; “এটা এখন পর্যন্ত আমার দেখা এ বছরের বেস্ট বাংলা ছবি, ইনফ্যাক্ট এটা আমার দেখা সরয়ার ফারুকীর সেরা সিনেমা”।
0 comments: